শ্বেত পাথরের বিগ্রহ (পর্ব-৫)
/ বিক্রমাদিত্য //
বিক্রমপুরের বেশির ভাগ উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ এক সময় কলকাতায় ব্যবসা বাণিজ্য করতো। হোক সে মুসলিম অথবা হিন্দু। এ পাড়ের শিক্ষিত হিন্দু শ্রেণী কলকাতায় উচ্চশ্রেণীর পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ব্যারিস্টার শিক্ষক বিক্রমপুরের ছিল একচেটিয়া অধিকারে। মুসলমানরা শিক্ষিত কম ছিলো বলে ব্যবসা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আমজাদ খান সাহেবও ঐ সময়ে কলকাতার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। বড় বাজারে ছিল তার তিন তিনটি বড় বড় পাইকারী দোকান।
বস্ত্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে তিনি ছিলেন হাতেগোনা কয়েক জনের মধ্যে একজন। যেমন নাম ডাক তেমনি সুনামের অধিকারী ছিলেন তিনি। শ্যামবাজারে ছিল তাঁর নিজ বাড়ি। একমাত্র ছেলে আজিম কলেজ পেরিয়ে সবেমাত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। স্ত্রী দাপটের সঙ্গে সংসার চালাতেন। অন্যান্য দিকগুলো আমজাদ খান সাহেব নিজেই দেখাশুনা করতেন। তাঁর বন্ধু সার্কেল ছিল কলকাতা শহরের কয়েকজন শীর্ষস্থায়ী নেত্রবৃন্দ। এই বন্ধু-বান্ধব বলতে গেলে সকলেই ছিলেন বিক্রমপুরের আদি বাসিন্দা। মালখানিরের পরিমল দাস ছিলেন একজন আইন শারদ। তিনি থাকতেন শ্যামবাজারে। কনকসারের অমল রায় দিলেন কলকাতার শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী। তিনি থাকতেন আলীপুরে। কোলাপাড়ার শঙ্কর ব্যার্ণাজী ছিলেন নামকরা উকিল। তিনি থাকতেন কলেজ স্ট্রিটে। বালিগাঁর নলিনীকান্ত দে ছিলেন বিশিষ্ট পুস্তক ব্যবাসয়ী। তিনি থাকতেন বেহালার ডায়মন্ড পার্কে। কুমারভোগের ডাঃ সোম ব্যার্ণাজী ছিলেন কলকাতার নামকরা ডাক্তার। তিনি থাকতেন ঢাকুরিয়া জর্তুপার্ক এলাকায়। কামারগাঁর আমীরখান ছিলেন বস্ত্র ব্যবসায়ী, তিনি থাকতেন শিয়ালদার নিজ বাড়িতে।
আমজাদ খান থাকতেন মালখানগরের পরিমল দাসের বাসার উল্টাদিকে। বেশিরভাগ সময়ে সকলে সঙ্গে সবার দেখা সাক্ষাত হতো গল্পওজব আড্ডা দিতো ইত্যাদি। সময়গুলো বেছে বেছে বের করতেন আমজাদ খান। আড্ডায় বসে বিক্রমপুরের স্মৃতিময় কাহিনীগুলোর কথা সর্বাগ্রে স্থান দখল করত। কখনও বালিগাঁয়ের হাট বসতো কখনও গোয়ালী মান্দ্রার হাট, কখনও শ্রীনগরের হাট। কত লোকসমাগম হতো, কি কি কেনাবেচা হতো, বাল্যকালের অমিয় স্মৃতিগুলো আড্ডা স্থল গরম করে রাখতো। গোয়ালী মান্দ্রার ছেঁকা রুটির আর রসগোল্লার কথা শুনলে সকলের জিহ্বায় জল এসে যেত। বিক্রমপুরের লোক হিসেবে কলকাতায় তাদের সম্মানও ছিল খ্যাতির মগডালে।
মুসলমানদের মধ্যে আমজাদ খান সাহেবের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন কামারগাঁয়ে আমীর খান। বলতে গেলে হরিহর আত্মা আরকি। বয়সও ছিল প্রায় কাছাকাছি। বন্ধু সার্কেলে সকলেই তুমি মম্বোধনটা ছিল মনে রাখার মতোন। বড় ছোট বাছ-বিচার ছিল না। শিয়ালদা আর শ্যামবাজার বেশি দূরে নয়। ইচ্ছে করলেই সকাল-বিকাল আসা যাওয়া তেমন কঠিন কিছু ছিলো নয়। আমজাদ খান প্রায়ই খেতেন আমীর খানের বাড়িতে। আবার আমীর খানও খেতেন আমজাদ খান সাহেরের বাড়িতে। মাঝে মধ্যে কোনোদিন হয়ত রাতও কাটাতেন এক সঙ্গে। পরের দিন আবার অন্য বন্ধুর বাসায় দুইজন এক সঙ্গে রাতের বারোটা বাজাতেন।
আমীর খানের দোকান ছিল আমজাদ খান সাহেবের দোকানের উল্টা দিকে। উত্তর-দক্ষিণে গলি। পশ্চিমপাশে আমজাদ খান পূর্বপাশে আমীর খান। দুই জনে দুই গদিতে বসলে প্রায়ই চোখাচোখী হতো। প্রচুর বিক্রির চাপে কেউ কারো দিকে নজর দিতে সময় হতো না। কিন্তু দুপুরের খাওয়ার সময় দুইজনে এক গদিতে বসে খাওয়া শেষ করতেন। আমীর খানের এক ছেলে, অলি আজাদ। এরা দুই বন্ধু চাইতেন পড়াশুনা শেষ করে একটা কিছু হোক। ব্যবসা করে কী নামি দামি কিছু হওয়া যায়? বড়জোর কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়। অলিও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশুনা করছে। বাবার মতো অলি ও আজিম একই সঙ্গে উঠাবসা করে। কলেজ স্ট্রিটে লাইব্রেরীতে খ্যাতবিখ্যাত লেখকের বই সংগ্রহ করে। পালাক্রমে বইগুলো দুইজনে পড়া শেষ করে। পাঁচ মাথার মোড়ে ঘোড়ার পিঠে নেতাজী সুভাষ বোসের শ্বেত পাথরের মূর্তি দেখতে অলির খুবই ভালো লাগে। অলি আহাদ মূর্তির দিকে তাকিয়ে ভাবে, কি করেছেন এই মানুষটি, কি কর্ম ফলে তিনি ভারত বর্ষের শোষিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কি দুর্দশনীয় সাহস নিয়ে ভারত বর্ষের বাইরে থেকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। চীন, জাপান, সিঙ্গাপুরের চারণ ভূমি আজও তাকে মনে রেখেছে। এক সময় তিনি জার্মানীর হিটলারকেও ধমক দিয়ে কথা বলে ছিলেন। কেমন ছিলো তার বুকের পাটা, কেমন ছিলো রক্তের টগবগ জ্বালাময়ী বক্তৃতা? আবার মনে পড়ে মহাত্মা গান্ধীর কথা। এই ছিপছিপে কংকালসার মানুষটি চষে বেড়িয়েছেন ভারতবর্ষের বেশির ভাগ এলাকায়। হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই। একজন ছাড়া অন্য জন নাই। একদিন হয়তো অলি থাকবে নাÑ সুভাষ বোস থাকবেন মহাত্মা থাকবে ভারতবর্ষ উন্নত হবে।
একদিন অলি আজিমকে প্রশ্ন করে বসে, ‘তুমি সুভাষ না মহাত্ম হবে?
মানুষ ইচ্ছে করলেই কি সবকিছু হতে পারে রে পাগল? অমন মানুষ হতে গেলে সাধনার দরকার, ধৈর্য্যরে দরকার, সময়ের দরকার, সর্বোপরি দরকার প্রেক্ষাপটের? আমাদের মতো চুনোপুঁটি কি অমন মহান মানুষ হতে পারে?
তাঁরা কি আমাদের মতো রক্ত মাংসের মানুষ ছিলেন না?
হ্যাঁ মানুষ ছিলেনÑ মানুষ তো মীর জাফরও ছিলেন, লর্ড ক্লাইডও ছিলেন, কার গভীরতা কতটুকু, কার স্থান কোথায়, তা কালই বলে দেয় রে অলি।
তুমি কি তাদের মতো হতে চাও?
অলি ধীরস্থির ভাবে জবাব দিলো এমন হতে কার না সাধ জাগে? মানুষের জীবনে অনেক সাধই জাগে কিন্তু বাস্তবে রূপ পায় না। সবার মাথার বুদ্ধি জ্ঞান সমান হয় না।
বুদ্ধি জ্ঞানও সবকিছু নয়রে অলি! চর্চা, চর্চাই হলো মানুষের জীবনের জীয়ন কাঠি। একবার যদি অমন মন্ত্র পেয়ে যাস, তখন বুঝবি। ইতিহাস কারে কয়।
অলি নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, অমন ভাগ্য কি হবে কখনো? হবে না, হবে না রে আজিম।
মানুষের অসাধ্য এ পৃথিবীতে কিছু নাই। কষ্টের তারতম্যে সফলতা আনে। তা কখনও হেলায় ফেলায় সুন্দর সময়টুকু হারিয়ে ফেলে। শেষে শূন্য হাতে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। পৃথিবীর মানুষ তাকে মনে রাখে নাÑ রাখার উছিলাও পায় না।
বড় একটা ছুটি পাওয়া গেলো। বন্ধুদের সম্মতির ও মর্যাল সার্পোট পাওয়া গেছে। কাজ আর কাজ। ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা। জীবন বড় বেখাপ্পা লাগে। মাঝে মাঝে একটু অবসর না কাটালে জীবনটা স্যাঁতস্যাঁতে মনে হয়। সামনের একটা মাস একেবারেই অবসর পাওয়া যাবে না। হাতে যখন পাঁচ ছ’টা দিন পাওয়া গেলো, তখন একটা ট্যুর দিয়ে আসলে কেমন হয়? আমির খান বললেন,
তোমার যা ইচ্ছে কর, আমি প্রস্তুত আছি। কিন্তু একটা কথা, সঙ্গে কিন্তু মহিলা টহিলা টানা যাবে না। আমরা পুরাতন বন্ধু-বান্ধব মিলে ট্যুরটা শেষ করবো।
আমজাদ খানও এই প্রস্তাবে সায় দিলেন। আশা করা গেল এতে অমত করার কারও কিছু থাকবে না। বৈঠক বসল কফি হাউসের ছিমছাম একটি কক্ষে। পরিমল দাস, অমল রায়, অজিতকুমার দাস, শঙ্কর ব্যানার্জী, আমীর খান ও আমজাদ খান। জাঁকজকম পোশাকাদি ও সুভাস ছড়িয়ে শোভাসেট দখল করলেন। যার যা প্রিয় খাবার তা অর্ডার দেয়া হলো। মুহুর্তের মধ্যে ভূতের মতোন কে কে যে কি নিয়ে এলো, কেউ আন্দাজ করতে পারল না। শুধু গল্প আর গল্প। কেউ বলে ভাগ্যকুলের জমিদারদের কথা, কেউ বলে মাইজপাড়ার জমিদারদের আচার-আচরণ নিয়ে কথা, কেউ প্রশংসা করে হাজরা বাড়ির জমিদারদের। কেউ দিঘলীর মিষ্টির কথা, কেউ বলে বারিগাঁর কাঠের কথা। কখনও বজ্রযোগিনী, কখনও রাঢ়ী খাল, কেউ বলে বিক্রমপুরের পোলা লাখটাকা তোলা। হ্যাঁ, হ্যাঁ শব্দে হেসে ওঠে এক সঙ্গে সবাই। হাসির সাথে কফি হাউস যেন কেঁপে কেঁপে উঠে। সবার পরিবারের গোপন কথা, স্ত্রীর গোপন প্রেম, শ্বশুর বাড়ির জামাই আদরের কথা। লাল মোরগের আলুর ঝোল। কৈ মাছ ভাজা, মাগুর মাছের গাঢ় ঝোল, আহা জিবে পানি এসে যায় আর কি! শ্যালক-শ্যালিকার ইয়ার্কি কাদা ছুঁড়াছুঁড়ি সাত আট দিন যদি কেউ শ্বশুর বাড়ি থাকত তবে ঠাণ্ডা সর্দি না এসে পারত না। আর বাড়ি ফেরার সময় সে কি কান্না, কান্নার হিড়িক পরে যেত। বউ কাঁদে, শ্বাশুড়ি কাঁদে, শ্যালক-শ্যালিকারা কাঁদে। গোপনে শ্বশুর বাবাও চোখ মোছেন গামছায়। জামাইবাবুও কি না কেঁদে পারেন। অগ্যতা পকেট থেকে রুমাল বের করতেই হয়। শেষমেষ শ্বশুর এসে জামাইবাবুর পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভাড়া বাবদ কিছু ধরিয়ে দেন।
সবাই আনন্দের সঙ্গে মজমার আলোচনা শুনছিল। শেষে পরিমল বাবু আরম্ভ করলেন, শোন, আমার পিসিমাকে দেখতে ভাগ্যকুলের জমিদার বাড়ি থেকে এক সমন্ধ এলো। আমার দাদামশায় বরকে জিজ্ঞেস করলেন,
তোমাদের এলাকায় বেগুনের দর কি? বরতো সহজেই উত্তর দিয়ে বসল,
পাঁচসের তিন পয়সা’, বরের বাস্তবজ্ঞান সম্মত উত্তর পেয়ে বাড়ির সকলেই খুশি, সবাই সমন্ধ করতে আগ্রহী হয়ে উঠল। আমার দাদা মশায় গম্ভীর মুখে উত্তর দিলেন,
এই ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে হবে না’। সবাই হতচকিত। ফ্যালফ্যাল করে দাদার দিকে তাকিয়ে রইল। দাদা বললেন,
যে জমিদারের ছেলে অতো ছোট বিষয়ে হিসাব রাখে সে জমিদার নয়, ছোট লোক শূদ্র শ্রেণীর। শূদ্রের সঙ্গে আমার মেয়ে বিয়ে দিতে পারি না। বর পক্ষ বাধ্য হয়ে ওঠে গেলেন। অজিত বললেন,
এখন আর সেই বিক্রমপুর নাইরে ভাই! জ্ঞানগরিমায় এক সময় বিশ্বে পরিচিত লাভ করলেও এখন অর্থই সেই স্থান দখল করেছে। ব্রাহ্মনের কন্যা এখন শূদ্র বিয়ে করে, সৈয়দ বংশের ছেলে এখন জেলের মেয়ে ঘরে আনে।
কোলাপাড়ার শঙ্কর ব্যানার্জী বললেন,
কথাটা যথার্থ বলেছো ভায়া। কিন্তু-এর ঢের ব্যতিক্রমও আছে। বেশি দিনের কথা নয়, গত বছর আমি বিক্রমপুরে গিয়েছিলাম, সঙ্গে আমার স্ত্রীও আছেন। আমাদের নিয়ে এক আত্মীয় কন্যা দেখতে হোমলাগাঁও গেলো। আমাদের ছেলে বিএ পাস করে এখন ইসলামপুরে বড় কাপড় ব্যবসায়ী। কর্মচারীর সংখ্যাও বিশ পঁচিশ জন। অবস্থা সম্পন্ন বাড়ির ছেলে। আপ্যায়নের পরে উভয়পক্ষের পছন্দের ব্যাপারটি স্থির হলে মেয়ের বাবা ছেলের শিক্ষাগতযোগ্যতা জানতে চাইলে, আমরা গর্বের সঙ্গে বিস্তারিত বিবরণাদি পেশ করলাম। তখন হঠাৎ মেয়ের বাপ হাত জোড় করে বললেন,
আমার মেয়ে এমএ পাস, আমি বিএ পাস পাত্রের নিকট মেয়ে দিতে পরি না। আমার ভুলত্র“টি ক্ষমা করবেন।
সম্মানের সাথে আমরা ওঠে আসতে বাধ্য হলাম। আমাদের বিএ পাস অগ্রহ্য হলো। এখনও বিক্রমপুরে ঐতিহ্যসম্পন্ন সচেতন লোক আছেন। যাঁরা বিক্রমপুরের গর্ব। তাঁদের আমি নমঙ্কার করি।
শিক্ষা সংস্কৃতিতে তাদের অবদান অনেক। অর্থ তাদের কাছে পত্র, আর খাদ্য হলো শিক্ষা। আমজাদ খানকে উদ্দেশ্য করে অমল রায় বললেন,
আমাদের ডেকেছো কি জন্য? কোনো মতলব ঠতলব আছে নিিক? আমজাদ খান বিস্তারিত বললেন, আমীর খান সায় দিলেন। সর্ববিষয়ে তর্ক, বিতর্কের ,পর পাঁচ দিনের ভ্রমণের স্থান নির্ধারিত হলো আগ্রার তাজমহল। তাজমহল ভালোবাসার প্রতীক। সকলের জীবনের সঙ্গে এই ভালোবাসাও অক্ষয় হয়ে থাকবে।
পরিমল দাস, অমল রায়, শঙ্কর ব্যানার্জী নলিনীকান্ত দে অজিদকুমার দাস ও আমজাদ খানকে নিয়ে আমীর খান বাড়ির দ্বিতীয় তলার একেবারে পশ্চিম দিকের খোলামেলা রুমে বসলেন। কোনরকম ভনিতা না করে আমীর খান বলতে শুরু করলেন,
সকলের ধর্ম সকলের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। সবারই উচিত শেষ কর্মটি সমাধা করা। আমিও আমার স্ত্রী এই শেষ কর্মটি এবার সমাধা করবো ইনসাল্লাহ। যাওয়া আসায় অন্তত মাস তিনেক সময় লাগবে। বয়স বেশি তাই স্থলপথে যাওয়া সম্ভব নয়Ñ ইস্টিমার যোগে যাবো। যাওয়ার আগে অনেক কথা মানুষের বলার থাকে। মরার কথা তো কেউ গ্যারান্টি দিতে পারে না। বলা তো যায় না যদি ফিরে না আসি। তখন আমার ব্যবসা-বাণিজ্য ঘরবাড়ি, একমাত্র ছেলে অলি আহাদের দায়িত্ব কে নেবে? সে জন্যই তোমাদের সকলকে ডাকা। আমার অনুপস্থিতিতে আমার সমস্ত সয়সম্পত্তি ও সন্তানের ভার আজাহারের নিকট দায়বদ্ধ থাকবে। আমি ফিরে এলে আবার আমার দায়ে চলবে। অবশ্য আমাদের দু’জনের মধ্যে আগেই কথা হয়েছে। তোমাদের স্বাক্ষী রাখার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে বলা। আল্লাহ স্বাক্ষী ছাড়া কোনো কাজ পছন্দ করেন না। অতএব আমার মনোবাসনা তোমাদের সম্মুখে উপস্থাপন করলাম। এখন তোমাদের সম্মতি প্রয়োজন।
উপস্থিত সকলেই তাঁর ব্যবস্থাপনার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। পরিমল বললেন,
যদিও আমরা ভিন্ন ধর্মের তবুও আমাদের জন্য তুমি মক্কায় গিয়ে দোয়া করো’ ঈশ্বর মক্কাতেও থাকেন কাশীতেও থাকেন। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন।
আমীর খান একটি উইল বের করলেন, যা তিনি শঙ্কর ব্যানার্জীর দ্বারা সকল কর্ম সম্পাদন করে রেখেছিলেন। বললেন,
তোমরা সকলেই এখানে স্বাক্ষর কর।
উইলের কার্য সম্পাদন শেষে আমির খান টলমল চোখে সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আল্লাহ আমার মনোবাঞ্ছা পূরণ করেছেন।
আমজাদ খান সাহেব অশ্র“সজল চোখে উইলটি গ্রহণ করলেন। চা’চক্র শেষে উপস্থিত সকলে বিদায় নিয়ে যার যার বাসস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
আজিম ও অলি আহাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি হয়েছিল। বিষয়টি বেছে নেয়ার প্রধান কারণ ছিল নেতাজী সুভাক্ষ বোস, মহাত্ম গান্ধী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এ. কে, ফজলুল হকদের ব্যক্তিত্ব দুইজনের হৃদমুকট বিদ্ধ করেছিল। অন্তরে অন্তরে গুপ্ত বাসনা হয়ত ছিলো। ভালো নেতা কে না হতে চায়? পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষই প্রকাশিত হতে চায়। ঈশ্বরও প্রকাশিত হওয়ার জন্য এ পৃথিবীর সৃষ্টি করেছেন। আনুষঙ্গিক পর্বত প্রমান দায়িত্ব তিনি মানুষের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছেন। সেই মানুষ কেন নিজেকে প্রকাশ করতে চাইবে না? কিন্তু বাইরে ব্যাপারটা অন্য কাউকে বুঝতে দিতো না ওরা। এঁদের পিতারা ও ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। অর্থের অভাব তাঁদের কখনোই ছিল না। ভালো বিষয়ে হয়ত ভর্তি হতে পারতো। নিজেদের অর্থের চাহিদা না থাকায় সে পথে তাঁরা পা মাড়ায় নি। পিতারাও বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামা নি। তারপরও বন্ধুসার্কেলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা তুলেছিলেন ওরা । সকলেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলে। কারণ আমাদের দেশে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের চেয়েও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়টি অধিকগুরুত্বপূর্ণ। ছেলেদের মাথায় যে বর্তমান যুগের ধ্যানধারণা বিচারবিশ্লেষণ করা ক্ষমতা আছে, সে জন্য সকলেই তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন। অলি আহাদ ও আজিম বিষয়টি জানতে পেরে অধিক উৎসাহ পেয়েছিল। কোনো দিগি¦দিক চিন্তা না করে তাদের পথেই এগিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হলো। (চলবে…)
———————————————
বইটি পাওয়া যাবে অমর একুশে বইমেলায়
বিক্রমপুরের বেশির ভাগ উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ এক সময় কলকাতায় ব্যবসা বাণিজ্য করতো। হোক সে মুসলিম অথবা হিন্দু। এ পাড়ের শিক্ষিত হিন্দু শ্রেণী কলকাতায় উচ্চশ্রেণীর পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ব্যারিস্টার শিক্ষক বিক্রমপুরের ছিল একচেটিয়া অধিকারে। মুসলমানরা শিক্ষিত কম ছিলো বলে ব্যবসা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আমজাদ খান সাহেবও ঐ সময়ে কলকাতার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। বড় বাজারে ছিল তার তিন তিনটি বড় বড় পাইকারী দোকান।
বস্ত্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে তিনি ছিলেন হাতেগোনা কয়েক জনের মধ্যে একজন। যেমন নাম ডাক তেমনি সুনামের অধিকারী ছিলেন তিনি। শ্যামবাজারে ছিল তাঁর নিজ বাড়ি। একমাত্র ছেলে আজিম কলেজ পেরিয়ে সবেমাত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। স্ত্রী দাপটের সঙ্গে সংসার চালাতেন। অন্যান্য দিকগুলো আমজাদ খান সাহেব নিজেই দেখাশুনা করতেন। তাঁর বন্ধু সার্কেল ছিল কলকাতা শহরের কয়েকজন শীর্ষস্থায়ী নেত্রবৃন্দ। এই বন্ধু-বান্ধব বলতে গেলে সকলেই ছিলেন বিক্রমপুরের আদি বাসিন্দা। মালখানিরের পরিমল দাস ছিলেন একজন আইন শারদ। তিনি থাকতেন শ্যামবাজারে। কনকসারের অমল রায় দিলেন কলকাতার শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী। তিনি থাকতেন আলীপুরে। কোলাপাড়ার শঙ্কর ব্যার্ণাজী ছিলেন নামকরা উকিল। তিনি থাকতেন কলেজ স্ট্রিটে। বালিগাঁর নলিনীকান্ত দে ছিলেন বিশিষ্ট পুস্তক ব্যবাসয়ী। তিনি থাকতেন বেহালার ডায়মন্ড পার্কে। কুমারভোগের ডাঃ সোম ব্যার্ণাজী ছিলেন কলকাতার নামকরা ডাক্তার। তিনি থাকতেন ঢাকুরিয়া জর্তুপার্ক এলাকায়। কামারগাঁর আমীরখান ছিলেন বস্ত্র ব্যবসায়ী, তিনি থাকতেন শিয়ালদার নিজ বাড়িতে।
আমজাদ খান থাকতেন মালখানগরের পরিমল দাসের বাসার উল্টাদিকে। বেশিরভাগ সময়ে সকলে সঙ্গে সবার দেখা সাক্ষাত হতো গল্পওজব আড্ডা দিতো ইত্যাদি। সময়গুলো বেছে বেছে বের করতেন আমজাদ খান। আড্ডায় বসে বিক্রমপুরের স্মৃতিময় কাহিনীগুলোর কথা সর্বাগ্রে স্থান দখল করত। কখনও বালিগাঁয়ের হাট বসতো কখনও গোয়ালী মান্দ্রার হাট, কখনও শ্রীনগরের হাট। কত লোকসমাগম হতো, কি কি কেনাবেচা হতো, বাল্যকালের অমিয় স্মৃতিগুলো আড্ডা স্থল গরম করে রাখতো। গোয়ালী মান্দ্রার ছেঁকা রুটির আর রসগোল্লার কথা শুনলে সকলের জিহ্বায় জল এসে যেত। বিক্রমপুরের লোক হিসেবে কলকাতায় তাদের সম্মানও ছিল খ্যাতির মগডালে।
মুসলমানদের মধ্যে আমজাদ খান সাহেবের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন কামারগাঁয়ে আমীর খান। বলতে গেলে হরিহর আত্মা আরকি। বয়সও ছিল প্রায় কাছাকাছি। বন্ধু সার্কেলে সকলেই তুমি মম্বোধনটা ছিল মনে রাখার মতোন। বড় ছোট বাছ-বিচার ছিল না। শিয়ালদা আর শ্যামবাজার বেশি দূরে নয়। ইচ্ছে করলেই সকাল-বিকাল আসা যাওয়া তেমন কঠিন কিছু ছিলো নয়। আমজাদ খান প্রায়ই খেতেন আমীর খানের বাড়িতে। আবার আমীর খানও খেতেন আমজাদ খান সাহেরের বাড়িতে। মাঝে মধ্যে কোনোদিন হয়ত রাতও কাটাতেন এক সঙ্গে। পরের দিন আবার অন্য বন্ধুর বাসায় দুইজন এক সঙ্গে রাতের বারোটা বাজাতেন।
আমীর খানের দোকান ছিল আমজাদ খান সাহেবের দোকানের উল্টা দিকে। উত্তর-দক্ষিণে গলি। পশ্চিমপাশে আমজাদ খান পূর্বপাশে আমীর খান। দুই জনে দুই গদিতে বসলে প্রায়ই চোখাচোখী হতো। প্রচুর বিক্রির চাপে কেউ কারো দিকে নজর দিতে সময় হতো না। কিন্তু দুপুরের খাওয়ার সময় দুইজনে এক গদিতে বসে খাওয়া শেষ করতেন। আমীর খানের এক ছেলে, অলি আজাদ। এরা দুই বন্ধু চাইতেন পড়াশুনা শেষ করে একটা কিছু হোক। ব্যবসা করে কী নামি দামি কিছু হওয়া যায়? বড়জোর কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়। অলিও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশুনা করছে। বাবার মতো অলি ও আজিম একই সঙ্গে উঠাবসা করে। কলেজ স্ট্রিটে লাইব্রেরীতে খ্যাতবিখ্যাত লেখকের বই সংগ্রহ করে। পালাক্রমে বইগুলো দুইজনে পড়া শেষ করে। পাঁচ মাথার মোড়ে ঘোড়ার পিঠে নেতাজী সুভাষ বোসের শ্বেত পাথরের মূর্তি দেখতে অলির খুবই ভালো লাগে। অলি আহাদ মূর্তির দিকে তাকিয়ে ভাবে, কি করেছেন এই মানুষটি, কি কর্ম ফলে তিনি ভারত বর্ষের শোষিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কি দুর্দশনীয় সাহস নিয়ে ভারত বর্ষের বাইরে থেকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। চীন, জাপান, সিঙ্গাপুরের চারণ ভূমি আজও তাকে মনে রেখেছে। এক সময় তিনি জার্মানীর হিটলারকেও ধমক দিয়ে কথা বলে ছিলেন। কেমন ছিলো তার বুকের পাটা, কেমন ছিলো রক্তের টগবগ জ্বালাময়ী বক্তৃতা? আবার মনে পড়ে মহাত্মা গান্ধীর কথা। এই ছিপছিপে কংকালসার মানুষটি চষে বেড়িয়েছেন ভারতবর্ষের বেশির ভাগ এলাকায়। হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই। একজন ছাড়া অন্য জন নাই। একদিন হয়তো অলি থাকবে নাÑ সুভাষ বোস থাকবেন মহাত্মা থাকবে ভারতবর্ষ উন্নত হবে।
একদিন অলি আজিমকে প্রশ্ন করে বসে, ‘তুমি সুভাষ না মহাত্ম হবে?
মানুষ ইচ্ছে করলেই কি সবকিছু হতে পারে রে পাগল? অমন মানুষ হতে গেলে সাধনার দরকার, ধৈর্য্যরে দরকার, সময়ের দরকার, সর্বোপরি দরকার প্রেক্ষাপটের? আমাদের মতো চুনোপুঁটি কি অমন মহান মানুষ হতে পারে?
তাঁরা কি আমাদের মতো রক্ত মাংসের মানুষ ছিলেন না?
হ্যাঁ মানুষ ছিলেনÑ মানুষ তো মীর জাফরও ছিলেন, লর্ড ক্লাইডও ছিলেন, কার গভীরতা কতটুকু, কার স্থান কোথায়, তা কালই বলে দেয় রে অলি।
তুমি কি তাদের মতো হতে চাও?
অলি ধীরস্থির ভাবে জবাব দিলো এমন হতে কার না সাধ জাগে? মানুষের জীবনে অনেক সাধই জাগে কিন্তু বাস্তবে রূপ পায় না। সবার মাথার বুদ্ধি জ্ঞান সমান হয় না।
বুদ্ধি জ্ঞানও সবকিছু নয়রে অলি! চর্চা, চর্চাই হলো মানুষের জীবনের জীয়ন কাঠি। একবার যদি অমন মন্ত্র পেয়ে যাস, তখন বুঝবি। ইতিহাস কারে কয়।
অলি নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, অমন ভাগ্য কি হবে কখনো? হবে না, হবে না রে আজিম।
মানুষের অসাধ্য এ পৃথিবীতে কিছু নাই। কষ্টের তারতম্যে সফলতা আনে। তা কখনও হেলায় ফেলায় সুন্দর সময়টুকু হারিয়ে ফেলে। শেষে শূন্য হাতে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। পৃথিবীর মানুষ তাকে মনে রাখে নাÑ রাখার উছিলাও পায় না।
বড় একটা ছুটি পাওয়া গেলো। বন্ধুদের সম্মতির ও মর্যাল সার্পোট পাওয়া গেছে। কাজ আর কাজ। ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা। জীবন বড় বেখাপ্পা লাগে। মাঝে মাঝে একটু অবসর না কাটালে জীবনটা স্যাঁতস্যাঁতে মনে হয়। সামনের একটা মাস একেবারেই অবসর পাওয়া যাবে না। হাতে যখন পাঁচ ছ’টা দিন পাওয়া গেলো, তখন একটা ট্যুর দিয়ে আসলে কেমন হয়? আমির খান বললেন,
তোমার যা ইচ্ছে কর, আমি প্রস্তুত আছি। কিন্তু একটা কথা, সঙ্গে কিন্তু মহিলা টহিলা টানা যাবে না। আমরা পুরাতন বন্ধু-বান্ধব মিলে ট্যুরটা শেষ করবো।
আমজাদ খানও এই প্রস্তাবে সায় দিলেন। আশা করা গেল এতে অমত করার কারও কিছু থাকবে না। বৈঠক বসল কফি হাউসের ছিমছাম একটি কক্ষে। পরিমল দাস, অমল রায়, অজিতকুমার দাস, শঙ্কর ব্যানার্জী, আমীর খান ও আমজাদ খান। জাঁকজকম পোশাকাদি ও সুভাস ছড়িয়ে শোভাসেট দখল করলেন। যার যা প্রিয় খাবার তা অর্ডার দেয়া হলো। মুহুর্তের মধ্যে ভূতের মতোন কে কে যে কি নিয়ে এলো, কেউ আন্দাজ করতে পারল না। শুধু গল্প আর গল্প। কেউ বলে ভাগ্যকুলের জমিদারদের কথা, কেউ বলে মাইজপাড়ার জমিদারদের আচার-আচরণ নিয়ে কথা, কেউ প্রশংসা করে হাজরা বাড়ির জমিদারদের। কেউ দিঘলীর মিষ্টির কথা, কেউ বলে বারিগাঁর কাঠের কথা। কখনও বজ্রযোগিনী, কখনও রাঢ়ী খাল, কেউ বলে বিক্রমপুরের পোলা লাখটাকা তোলা। হ্যাঁ, হ্যাঁ শব্দে হেসে ওঠে এক সঙ্গে সবাই। হাসির সাথে কফি হাউস যেন কেঁপে কেঁপে উঠে। সবার পরিবারের গোপন কথা, স্ত্রীর গোপন প্রেম, শ্বশুর বাড়ির জামাই আদরের কথা। লাল মোরগের আলুর ঝোল। কৈ মাছ ভাজা, মাগুর মাছের গাঢ় ঝোল, আহা জিবে পানি এসে যায় আর কি! শ্যালক-শ্যালিকার ইয়ার্কি কাদা ছুঁড়াছুঁড়ি সাত আট দিন যদি কেউ শ্বশুর বাড়ি থাকত তবে ঠাণ্ডা সর্দি না এসে পারত না। আর বাড়ি ফেরার সময় সে কি কান্না, কান্নার হিড়িক পরে যেত। বউ কাঁদে, শ্বাশুড়ি কাঁদে, শ্যালক-শ্যালিকারা কাঁদে। গোপনে শ্বশুর বাবাও চোখ মোছেন গামছায়। জামাইবাবুও কি না কেঁদে পারেন। অগ্যতা পকেট থেকে রুমাল বের করতেই হয়। শেষমেষ শ্বশুর এসে জামাইবাবুর পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভাড়া বাবদ কিছু ধরিয়ে দেন।
সবাই আনন্দের সঙ্গে মজমার আলোচনা শুনছিল। শেষে পরিমল বাবু আরম্ভ করলেন, শোন, আমার পিসিমাকে দেখতে ভাগ্যকুলের জমিদার বাড়ি থেকে এক সমন্ধ এলো। আমার দাদামশায় বরকে জিজ্ঞেস করলেন,
তোমাদের এলাকায় বেগুনের দর কি? বরতো সহজেই উত্তর দিয়ে বসল,
পাঁচসের তিন পয়সা’, বরের বাস্তবজ্ঞান সম্মত উত্তর পেয়ে বাড়ির সকলেই খুশি, সবাই সমন্ধ করতে আগ্রহী হয়ে উঠল। আমার দাদা মশায় গম্ভীর মুখে উত্তর দিলেন,
এই ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে হবে না’। সবাই হতচকিত। ফ্যালফ্যাল করে দাদার দিকে তাকিয়ে রইল। দাদা বললেন,
যে জমিদারের ছেলে অতো ছোট বিষয়ে হিসাব রাখে সে জমিদার নয়, ছোট লোক শূদ্র শ্রেণীর। শূদ্রের সঙ্গে আমার মেয়ে বিয়ে দিতে পারি না। বর পক্ষ বাধ্য হয়ে ওঠে গেলেন। অজিত বললেন,
এখন আর সেই বিক্রমপুর নাইরে ভাই! জ্ঞানগরিমায় এক সময় বিশ্বে পরিচিত লাভ করলেও এখন অর্থই সেই স্থান দখল করেছে। ব্রাহ্মনের কন্যা এখন শূদ্র বিয়ে করে, সৈয়দ বংশের ছেলে এখন জেলের মেয়ে ঘরে আনে।
কোলাপাড়ার শঙ্কর ব্যানার্জী বললেন,
কথাটা যথার্থ বলেছো ভায়া। কিন্তু-এর ঢের ব্যতিক্রমও আছে। বেশি দিনের কথা নয়, গত বছর আমি বিক্রমপুরে গিয়েছিলাম, সঙ্গে আমার স্ত্রীও আছেন। আমাদের নিয়ে এক আত্মীয় কন্যা দেখতে হোমলাগাঁও গেলো। আমাদের ছেলে বিএ পাস করে এখন ইসলামপুরে বড় কাপড় ব্যবসায়ী। কর্মচারীর সংখ্যাও বিশ পঁচিশ জন। অবস্থা সম্পন্ন বাড়ির ছেলে। আপ্যায়নের পরে উভয়পক্ষের পছন্দের ব্যাপারটি স্থির হলে মেয়ের বাবা ছেলের শিক্ষাগতযোগ্যতা জানতে চাইলে, আমরা গর্বের সঙ্গে বিস্তারিত বিবরণাদি পেশ করলাম। তখন হঠাৎ মেয়ের বাপ হাত জোড় করে বললেন,
আমার মেয়ে এমএ পাস, আমি বিএ পাস পাত্রের নিকট মেয়ে দিতে পরি না। আমার ভুলত্র“টি ক্ষমা করবেন।
সম্মানের সাথে আমরা ওঠে আসতে বাধ্য হলাম। আমাদের বিএ পাস অগ্রহ্য হলো। এখনও বিক্রমপুরে ঐতিহ্যসম্পন্ন সচেতন লোক আছেন। যাঁরা বিক্রমপুরের গর্ব। তাঁদের আমি নমঙ্কার করি।
শিক্ষা সংস্কৃতিতে তাদের অবদান অনেক। অর্থ তাদের কাছে পত্র, আর খাদ্য হলো শিক্ষা। আমজাদ খানকে উদ্দেশ্য করে অমল রায় বললেন,
আমাদের ডেকেছো কি জন্য? কোনো মতলব ঠতলব আছে নিিক? আমজাদ খান বিস্তারিত বললেন, আমীর খান সায় দিলেন। সর্ববিষয়ে তর্ক, বিতর্কের ,পর পাঁচ দিনের ভ্রমণের স্থান নির্ধারিত হলো আগ্রার তাজমহল। তাজমহল ভালোবাসার প্রতীক। সকলের জীবনের সঙ্গে এই ভালোবাসাও অক্ষয় হয়ে থাকবে।
পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ তাজমহল দেখতে
আসেন। যাঁরা ভালোবাসার বন্ধনে চিরকাল আবদ্ধ তাঁরা বৃদ্ধ হলেও একবারের জন্যে
তাজমহলের দোর গোড়ায় পা রাখেন। তাঁদের হৃদয়ে তখন ভেসে ওঠে ভালোবাসার আম্লান
স্মৃতি। কারও কারও হৃদয়ে আবার ভেসে ওঠে মধুর বেদনা । তাঁরা তাজমহলের
নিরাকার আবেদনের মধ্যে একাকার হয়ে যান। পৃথিবীর বড় বড় কবির কবিতায় তাজমহলের
শোকগাথা অথবা প্রেম সৌন্দর্য বিকশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ও তাজমহলের
গুণকীর্তন করেছেন, করেছেন সুখ্যাতি লেখনীর মাধ্যমে। কালের কপোল তলে শুভ্র এ
তাজমহল। চলমান গতির স্রোতে শাহজাহান ও মমতাজ হারিয়ে গেলেও তাজমহল কালের
স্রোতে বয়ে চলবে অনন্ত কাল। কার হৃদয়ে প্রেম ভালোবাসা না আছে? সমস্ত
সৃষ্টিকুলের অন্তরে প্রেম আছে, আছে ঈশ্বরে প্রেম। তিনি প্রেমের সাগরের
ভাসছেন। জগত জুড়ে প্রেমখেলা করে। সে খেলা অনেকেই অনুভব করতে পারে। আবার
অনেকে পারে না। যাঁরা পারেন তারা হন ভাবুক নয়তো কবি। পৃথিবী ও কাউকে না
কাউকে ভালোবাসে। তার অপার সৌন্দর্য জগতে ইশারায় ডাকেন। কাকে কাকে তিনি
ডাকেন? কেন ডাকেন? তার আহ্বানে কে আসবে এগিয়ে পানপাত্র নিয়ে? পৃথিবীর বুকে
বিচরণশীল প্রাণীর জীবনেও নীরবে প্রেম আসে, মনে মনে গড়েন তাজমমহল। সেই
তাজমহলে গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে আজীবন আত্মতৃপ্তির তাজা অথবা শুকনো
মাল্যপ্রদান করেন।
সময় বড় আশ্চর্য অনুভূতি। কেউ যদি একবার হারিয়ে ফেলে তাহলে আর ফেরানো যায়
না। সকলেই এগিয়ে যায় সময়ের মাথায় চরে, সময়ের চাহিদা অনেকেই বোঝে, আবার
বোঝে না। সময় মানুষকে শান্তির জলে স্নান করিয়ে দেয় কিন্তু নিজে কখনও স্নান
করে না। সে স্নানে যে কি আনন্দ, কি শান্তি সময় তা জানে না। আমীর খান
সাহেবেরও বয়স হয়েছে। ধর্মীয় চেতনা বোধ হৃদয়ে স্থান নিয়েছে। মানুষের বয়সের
ধাপে ধাপে ধর্মীয় অনুভূতিরও রূপ পাল্টায়। আমীর খান স্থির সিদ্ধান্তগ্রহণ
করলেন একবার মক্কা মদীনা আল্লাহ রাসুলের (সা.) ঘর প্রদক্ষিণ না করে
মৃত্যুবরণ করবেন না। আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি এবার পশ্চিমে যাবেন। যাওয়ার আগে
দোয়া, ভোজের আয়োজন করলেন। হিন্দু-মুসলমান সকলেই আসলেন। শিয়ালদার বাড়িতে
লোকে লোকারণ্য। আহার ও দোয়া শেষে সবাই বিদায় নিলেন। আমীর সাহেবের অনুরোধে
কয়েকজন পুরাতন বন্ধু রয়ে গেলেন। তাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে।পরিমল দাস, অমল রায়, শঙ্কর ব্যানার্জী নলিনীকান্ত দে অজিদকুমার দাস ও আমজাদ খানকে নিয়ে আমীর খান বাড়ির দ্বিতীয় তলার একেবারে পশ্চিম দিকের খোলামেলা রুমে বসলেন। কোনরকম ভনিতা না করে আমীর খান বলতে শুরু করলেন,
সকলের ধর্ম সকলের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। সবারই উচিত শেষ কর্মটি সমাধা করা। আমিও আমার স্ত্রী এই শেষ কর্মটি এবার সমাধা করবো ইনসাল্লাহ। যাওয়া আসায় অন্তত মাস তিনেক সময় লাগবে। বয়স বেশি তাই স্থলপথে যাওয়া সম্ভব নয়Ñ ইস্টিমার যোগে যাবো। যাওয়ার আগে অনেক কথা মানুষের বলার থাকে। মরার কথা তো কেউ গ্যারান্টি দিতে পারে না। বলা তো যায় না যদি ফিরে না আসি। তখন আমার ব্যবসা-বাণিজ্য ঘরবাড়ি, একমাত্র ছেলে অলি আহাদের দায়িত্ব কে নেবে? সে জন্যই তোমাদের সকলকে ডাকা। আমার অনুপস্থিতিতে আমার সমস্ত সয়সম্পত্তি ও সন্তানের ভার আজাহারের নিকট দায়বদ্ধ থাকবে। আমি ফিরে এলে আবার আমার দায়ে চলবে। অবশ্য আমাদের দু’জনের মধ্যে আগেই কথা হয়েছে। তোমাদের স্বাক্ষী রাখার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে বলা। আল্লাহ স্বাক্ষী ছাড়া কোনো কাজ পছন্দ করেন না। অতএব আমার মনোবাসনা তোমাদের সম্মুখে উপস্থাপন করলাম। এখন তোমাদের সম্মতি প্রয়োজন।
উপস্থিত সকলেই তাঁর ব্যবস্থাপনার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। পরিমল বললেন,
যদিও আমরা ভিন্ন ধর্মের তবুও আমাদের জন্য তুমি মক্কায় গিয়ে দোয়া করো’ ঈশ্বর মক্কাতেও থাকেন কাশীতেও থাকেন। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন।
আমীর খান একটি উইল বের করলেন, যা তিনি শঙ্কর ব্যানার্জীর দ্বারা সকল কর্ম সম্পাদন করে রেখেছিলেন। বললেন,
তোমরা সকলেই এখানে স্বাক্ষর কর।
উইলের কার্য সম্পাদন শেষে আমির খান টলমল চোখে সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আল্লাহ আমার মনোবাঞ্ছা পূরণ করেছেন।
আমজাদ খান সাহেব অশ্র“সজল চোখে উইলটি গ্রহণ করলেন। চা’চক্র শেষে উপস্থিত সকলে বিদায় নিয়ে যার যার বাসস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
আজিম ও অলি আহাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি হয়েছিল। বিষয়টি বেছে নেয়ার প্রধান কারণ ছিল নেতাজী সুভাক্ষ বোস, মহাত্ম গান্ধী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এ. কে, ফজলুল হকদের ব্যক্তিত্ব দুইজনের হৃদমুকট বিদ্ধ করেছিল। অন্তরে অন্তরে গুপ্ত বাসনা হয়ত ছিলো। ভালো নেতা কে না হতে চায়? পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষই প্রকাশিত হতে চায়। ঈশ্বরও প্রকাশিত হওয়ার জন্য এ পৃথিবীর সৃষ্টি করেছেন। আনুষঙ্গিক পর্বত প্রমান দায়িত্ব তিনি মানুষের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছেন। সেই মানুষ কেন নিজেকে প্রকাশ করতে চাইবে না? কিন্তু বাইরে ব্যাপারটা অন্য কাউকে বুঝতে দিতো না ওরা। এঁদের পিতারা ও ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। অর্থের অভাব তাঁদের কখনোই ছিল না। ভালো বিষয়ে হয়ত ভর্তি হতে পারতো। নিজেদের অর্থের চাহিদা না থাকায় সে পথে তাঁরা পা মাড়ায় নি। পিতারাও বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামা নি। তারপরও বন্ধুসার্কেলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা তুলেছিলেন ওরা । সকলেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলে। কারণ আমাদের দেশে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের চেয়েও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়টি অধিকগুরুত্বপূর্ণ। ছেলেদের মাথায় যে বর্তমান যুগের ধ্যানধারণা বিচারবিশ্লেষণ করা ক্ষমতা আছে, সে জন্য সকলেই তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন। অলি আহাদ ও আজিম বিষয়টি জানতে পেরে অধিক উৎসাহ পেয়েছিল। কোনো দিগি¦দিক চিন্তা না করে তাদের পথেই এগিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হলো। (চলবে…)
———————————————
বইটি পাওয়া যাবে অমর একুশে বইমেলায়
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন